নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের পাশে বসবাসকারী নানা পরিবার,বিভিন্ন চরাঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন, পদ্মা-মেঘনার ভাঙনে ক্রমশ বাস্তচ্যূত হয়ে নি:স্ব হচ্ছে। তাইতো ২০১৭ সালে এখানে স্থায়ী এবং শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণের লক্ষ্যে ‘চাঁদপুর শহর সুরক্ষা’ নামে একটি প্রকল্প প্রস্তুত করা হয় । কিন্তু দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরেও সেই প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি । এটি কবে বাস্তবায়নে রুপ নেবে তা সংশ্লিষ্টদের কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতেও পারছেন না। দেখা যাচ্ছে চলতি বর্ষা মওসুমে হঠাৎ মেঘনা নদীর করাল গ্র্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে বসতভিটা , শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ফসলি জমি। বর্তমানে চাঁদপুর সদর, হাইমচর ও মতলব উত্তর উপজেলার ২৪টি ইউনিয়নের কয়েকশত পরিবার নদীর ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে।
চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: জহিরুল ইসলাম জানান চাঁদপুর শহর রক্ষায় ভাঙনরোধে দুই বছর আগে স্টাডির মাধ্যমে ডিপিপি করে প্ল্যানিং কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে।এখন সেখান থেকে অনুমোদন হলে কাজ শুরু করা যাবে । বর্তমানে বর্ষা মওসুমে ভাঙন রোধে তাৎক্ষণিক ইমাজেন্সি হিসেবে ব্লক ও জিও ব্যাগ মজুদ আছে । এ সময় সে ধরণের পরিস্থিতিতে কোনো সমস্যা হবেনা বলে জানান এ কর্মকর্তা।
চাঁদপুর সদরের মেঘান নদীর পশ্চিমে নদী বেষ্টিত ব্যাপক জনঅধ্যূষিত রাজরাজেশ^র ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হযরত আলী বেপারী জানান, আমাদের পুরো ইউনিয়নটি পদ্মা ও মেঘনা নদীর ভাঙনের শিকার। প্রতি বছর বর্ষা আসলে চরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকেনা । এ পর্যন্ত ৬ থেকে ৭ বার ভেঙেছে ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা। সরকার সংরক্ষণ ব্যবস্থা না করলে অচিরেই জেলার মানচিত্র থেকে বিশাল জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিয়নটি হারিয়ে যাবে।
হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের ইশানবালা এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান জানান, ইশানবালার ভাঙনরোধে কয়েকবার পানি উন্নয়ন বোর্ড বালু ভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ দিয়ে প্রতিরোধ করলেও কোন লাভ হয়নি। বর্ষা চলছে । ভাঙনের মাত্রাও বাড়ছে ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মেঘনা ধনাগোদা প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত বর্তমানে চাঁদপুরের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, জেলার মতলব উত্তর উপজেলা থেকে শুরু করে হাইমচর উপজেলা পর্যন্ত পদ্মা নদী ৫ কিলোমিটার, মেঘনা নদী ৫৮ কিলোমিটার। বর্তমানে ভাঙন প্রবণ এলাকা প্রায় ১২ কিলোমিটার। এ পর্যন্ত চাঁদপুর সদর ও হাইমচরে নদী তীর সংরক্ষণ হয়েছে ২১.৫৮৯ কিলোমিটার। বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ১০.৩০০ কিলোমিটার। এরমধ্যে হানারচর হতে হামইচর উপজেলার নয়ানী ৪ কিলোমিটার, হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদীর পশ্চিমে ইশানবালায় ৪.৩০০ কিলোমিটার এবং একই উপজেলার আলু বাজার এলাকায় ২ কিলোমিটার। তিনি আরো জানান, বর্তমান সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত চাঁদপুর পওর বিভাগ নদী তীর সংরক্ষণ কাজ করেছে ১৫.৫৩৯ কিলোমিটার। চাঁদপুর সদর উপজেলার হানারচর ইউনিয়নের হরিণা ফেরিঘাট এবং হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী কাটাখাল রক্ষা প্রকল্পে ১.৬০০ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ কাজ চলমান আছে।
ইতোপূর্বে মেঘনার ভাঙন থেকে চাঁদপুর শহরকে রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্ষা বিভিন্ন চেহারা নিয়ে এলেও চাঁদপুরে আসে বিভীষিকাময় চেহারা নিয়ে। ভাঙন শুরু হলে নদী প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুতিরও সময় দেয় না। আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে বলতে চাই এই মুহূর্তেই শহর রক্ষার কাজ শুরু করতে হবে। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইডাব্লি¬উএম ও সিইজিআইএস কর্তৃক আয়োজিত মতবিনিময় কর্মশালায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ওই কর্মশালায় মন্ত্রী বলেন, সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পাস হওয়ার আগেই শহরকে রক্ষা করতে হবে। জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসানের সভাপতিত্বে ওই সভায় ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সহ পাউবোর উর্ধŸতন কর্মকর্তারা ।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সেন্টার ফর এনভায়রমেন্টাল এণ্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশান সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) সমীক্ষার প্রতিবেদন থেকে নানা তথ্য জানা যায়। ১৯৭২ সালে চাঁদপুর শহর নদী ভাঙনে আক্রান্ত হয়। তখন সরকার নিজস্ব অর্থায়নে চাঁদপুর শহর রক্ষা প্রকল্প (১ম পর্যায়) কাজ শুরু করে। এরপর ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পরে এফডিআরের অধীনে চাঁদপুর শহর রক্ষার জন্য সীমিত আকারে কাজ করা হয়। ১৯৯৭ সালে সম্পূর্ণ পাউবোর নিজস্ব পরিকল্পনা ও নকশার মাধ্যমে চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ প্রকল্প (২য় পর্যায়) কাজ আরম্ভ হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর শহর রক্ষা বাঁধ আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। সর্বশেষ চাঁদপুর শহর সুরক্ষার জন্য ৩ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ হাজার ৩শ’ ৬০ মিটারের একটি প্রকল্প চূড়ান্ত করে পাউবো।
এই প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, চাঁদপুর শহরের অবস্থান মেঘনার বাম তীরে, যেখানে মেঘনা ও পদ্মার প্রবাহ মিশেছে। সেই এলাকাটি অত্যন্ত প্রশস্ত এবং গভীর। নদীর ভাঙনে শহরটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে শুধু শহরই রক্ষা পাবে তা নয়,মূল্যবান জমি ও সম্পদ বাঁচবে এবং নদী ভাঙন থেকে নদীতীরের বাসিন্দারাও রক্ষা পাবে। ফসলের ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে । জলজ বাস্তুসংস্থানের অবস্থার উন্নতি হবে ।সর্বপরি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে এখানে।