নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
‘অলৌকিকভাবে’ লাগা আগুনে ঘরছাড়া চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের পূর্ব দায়ছারা গ্রামের এক পরিবার।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দায়ছারা গ্রামের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন পাটওয়ারীর দুটি ঘরে আগুন লেগে কিছু সময় পরে আবার নিভে যায়।
হঠাৎ দিনের আলোতে পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীদের সামনে এমন ঘটনা ঘটছে। কখনও আসবাবপত্রে, কখনও জামা-কাপড়ে, কখনও ঘরের চালে, এমনকি ফ্রিজেও লেগেছে আগুন। এমনিভাবে পার হয়েছে প্রায় ৭ থেকে ৮ মাস।
কী কারণে আগুন লাগছে এর কোনো রহস্য কেউ বলতে পারেনি। একাধিক কবিরাজ দিয়ে তাবিজ লাগিয়ে এবং গরু কেটে মিলাদ ও দোয়া পড়িয়ে রেহাই মিলছে না।
এই অলৌকিক অগ্নিকাণ্ডে বর্তমানে সপরিবারে ঘরের বাইরে অবস্থান করছেন শাহাদাত হোসেন পাটওয়ারী। এদিকে অদৃশ্য আগুন আতঙ্কে গ্রামবাসীও।
রোববার (১৭ ডিসেম্বর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওই বাড়িতে অবস্থান করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে আগুন লাগার ঘটনার সত্যতা মিলে। তবে কেন আর কীভাবে আগুন লাগছে, সেই রহস্য ভেদ করা যায়নি।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ভুক্তভোগী শাহাদাত পাটওয়ারীর পেশায় কৃষক। তার স্ত্রী, ৪ ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে তার স্ত্রী, এক ছেলে, ছেলের স্ত্রী ও নাতি থাকেন। তারা বর্তমানে দিনের বেলায় বাড়িতে থাকেন আর রাতে অন্যস্থানে ঘুমাতে যান।
এমনটি করার কারণ জানিয়েছেন এ পরিবারের প্রতিবেশী কামরুল হাসান। তিনি বলেন, রাতে আগুন লাগে না। আর আগুনে কোনো আসবাবপত্র পুরোটা পুড়ে যায় না। আংশিক পুড়ে যায়। আবার কিছু সময় পরে নিভে যায়। কবিরাজ দিয়ে তাবিজ লাগিয়ে কোনো কাজ হয় না। আগুন লাগে আবার কয়েকদিন বন্ধ থেকে ফের আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা ফজলুল করিম ও মান্নান খান জানান, এমন আগুন লাগার ঘটনা কখনো দেখিনি। শাহাদাত পাটওয়ারী ঘরের ফ্রিজেও আগুন লেগেছে। কেউ দেখতে গেলে তাদের গায়েও আগুন লাগে। বিভিন্ন চেষ্টা করেও পরিবারটি রেহাই পাচ্ছে না।
সবশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর আগুন লাগে বলে তথ্য দেন স্থানীয় নোয়াব আলী বাড়ির এমরান হোসেন। সেই তথ্য দিতে গিয়ে তিনি জানালেন, শাহাদাত পাটওয়ারীর ঘর থেকে আসবাবপত্র নিয়ে মসজিদেও রাখা হয়। সেখানেও আগুন লাগে।
তিনি বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ আগুন লাগার ঘটনা বেড়েছে। গ্রামের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন লোক এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে একবার দমকল বাহিনীর লোকও আসেন। আগুন লাগার পরে ঘরের আসবাবপত্র ও জামা কাপড় পাশের মসজিদে নিয়ে রাখে। সেখানে মসজিদের ভেতরেও আগুন লেগে যায়।
পাশের রামদাসের ভাগ গ্রামের ওসমান খান ও ফয়সাল জানান, এই ঘটনা জানতে পেরে আমরা দেখতে এসেছি। এই পরিবারের করুণ এই দৃশ্য দেখতে অনেকেই আসছেন। আবার অনেকে আতঙ্কে ওই বাড়িতে প্রবেশ করেন না। কারণ, ঘরের ভেতরে প্রবেশ করার পর শরীরের আগুন লেগে যায় অনেকের।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আসাদুজ্জামান আমরুল বলেন, আমাকে শাহাদাত হোসেনের বাড়ির পাশে বেশি সময় থাকতে হয়। কারণ এখানে আমার একটি পোলট্রি খামার আছে। গত ৭-৮ মাস আগ থেকেই এই আগুনের ঘটনা। আমরা বহুবার আগুন লাগার পরে বাড়িতে গিয়েছি। কিন্তু আগুনের কোনো সূত্রপাত খুঁজে পাইনি। আমাদের ধারণা এটি কোন অদৃশ্য বিষয়। আল্লাহর অশেষ রহমত ছাড়া এই পরিবারের কোনো রক্ষা দেখি না। এই শীতের মধ্যে তারা গায়ে জামা কাপড় রাখতে পারে না এবং ঘরে ঘুমাতে পারে না।
ভুক্তভোগী শাহাদাত হোসেন পাটওয়ারী বলেন, আমি গত ৭-৮ মাসে আগুনের ঘটনায় খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। আমার বয়স ৭০ বছরের বেশি। আগুনের ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে বহুভাবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু রেহাই মিলছে না। বেশি কথা বলতে পারি না। আমি সকলের দোয়া চাই।
এমন অদ্ভুত ঘটনার বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পরিচালক ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তার সঙ্গে।
আগুন লাগার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর গ্রাহক প্রতিনিধি (পরিচালক) আলী আজম রেজা জানান, ওই বাড়িতে তার উপস্থিতিতেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে এবং এসব অগ্নিকাণ্ডে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের বিষয় জড়িত নয়।
তিনি বলেন, ঘটনাটি পূর্বে থেকে শুনে আসছি। প্রথমে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি নিজে যখন গিয়ে দেখলাম এবং আমাদের সামনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। তখন থেকেই বিশ্বাস করেছি। বৈদ্যুতিক কোনো সমস্যা আছে কিনা সেটিও আমি পরীক্ষা করিয়েছি। বিদ্যুৎ সরবরাহ শতভাগ সঠিক। এই পরিবারটি এখন খুবই অসহায়। গ্রামবাসীও আতঙ্কে রয়েছেন। বিষয়টি সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অনুসন্ধান করে দেখার অনুরোধ করছি।
ফরিদগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ কামরুল হাসান বলেন, গত ১২ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) দুপুরে শাহাদাত পাটওয়ারীর বাড়িতে আগুন লাগলে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে যাওয়ার পূর্বেই স্থানীয়রা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন জিনিসপত্র আমরা দেখতে পেয়েছি। ওই বাড়ির অনেক কিছুতে আগুনে লেগেছে বলে জানতে পারি। কিন্তু কোন অদৃশ্য কারণে এই আগুন কেউই বলতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করতে আমাদের মহাপরিচালক বরাবর ওই বাড়ির মালিক আবেদন করতে পারবেন। এরপর আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে জানতে তদন্ত কমিটি গঠনসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে পারবে।