
আনোয়ারুল হক ॥
সড়কের পাশেই দেখা মিলছে রসালো ফল আঙুরের। বাঁশের মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলছে লাল-সবুজ রঙের মিষ্টি জাতের আঙুর। দৃষ্টি কাড়ছে পথচারী ও দর্শনার্থীদের। আঙুরের থোকায় কৃষি উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান প্রধানিয়ার চোখে এখন রঙিন স্বপ্ন। এই উদ্যোক্তা বলছেন, চাঁদপুরের মাটিতে আঙুর চাষ করে সফল হওয়া সম্ভব। এর মধ্যে চাঁদপুর জেলায় এটি চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
চাঁদপুর সদর উপজেলার আশিকাটি ইউনিয়নের রালদিয়ার গ্রামের আব্দুর রহমান প্রধানিয়ার ছেলে কামরুজ্জামান প্রধানিয়া। ২০১৯ সালে বাড়ির ছাদে আঙুর গাছের ২-৩টি দেশীয় জাতের কিছু সংখ্যক চারা নিয়ে শখের বসে চাষ শুরু করেন তিনি। এরপর বেশ কয়েকটি দেশীয় জাতের চাষ করেন। পরে ২০২১ সালে থেকে বিদেশি জাতের আঙুর চাষ নিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০২৩ সাল থেকে আঙুর ফলনে বেশ ভালো ফলাফল পান। ২০২৪ সালে জুন মাসে ২০ শতক জমিতে চাঁদপুর সদর উপজেলার চাঁদপুর-মতলব সড়কের পাশে বাণিজ্যিকভাবে ফলনের আঙুর চাষাবাদ শুরু করেন। তার সংগ্রহে এখন পর্যন্ত ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের শতাধিক জাতের আঙুর গাছ রয়েছে। এসব জাতের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৩৫টি জাতের আঙুর হারভেস্ট করেন। তার মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে আটটি জাতের উৎপাদন করছেন। এ বছর ১০ হাজার চারা তৈরি হচ্ছে। তিনি এই প্রকল্পের নাম দিয়েছেন প্রধানীয়া অ্যাগ্রো প্রজেক্ট-১, প্রজেক্ট-২ ও প্রজেক্ট-৩। এর একটি প্রজেক্ট ৩৪ শতক জমি। তার ৮টি বাণিজ্যিক আঙুরের জাতগুলো হচ্ছে গ্রিন লঙ, একেলো, বাইকো নুর, লোরাস, ভেলেজ, ডিকসন, সুপার নোভা, নারু সিডলেস।
জানা গেছে, বাংলাদেশে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আঙুর গাছ ছাঁটাই করলে মার্চ-এপ্রিলে ফল পাওয়া যায়। এরপর আবার শীতের সময়ে ফলন আসে। সাধারণত আঙুর চাষের জন্য এমন জায়গা দরকার হয় যেখানে পরিমিত বৃষ্টি হবে, কিন্তু মাটিতে পানি জমে থাকবে না। আবার আবহাওয়া হতে হবে শুষ্ক ও উষ্ণ। আঙুর পাকার সময় বৃষ্টি হলে আঙুরের গুণাগুণসহ আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। আবার আঙুর পাখি খেয়ে ফেলে বলে এ নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। পরিমিত মাত্রায় সার ও যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে একটি আঙুর গাছই বছরের পর বছর ধরে ফলন দিতে পারে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কামরুজ্জামান প্রধানিয়ার চাঁদপুর-মতলব সড়কের পাশে প্রধানীয়া অ্যাগ্রো প্রজেক্ট-১-এর আঙুর বাগানে বাঁশের মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলছে লাল-সবুজ রঙের মিষ্টি জাতের আঙুর। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দর্শনার্থীরা চারা ক্রয় ও বাগান পরিদর্শন করছেন।
জেলার কৃষি বিভাগ বলছে, কামরুজ্জামানের আঙুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি চাষাবাদের উপযুক্ত হয় তাহলে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
ফরিদগঞ্জ থেকে আসা টিটু নামে এক যুবক বলেন, আমি এই আঙুরের বাগান দেখতে এসেছি। আঙুরগুলো অনেক সুন্দর ও মিষ্টি, আমি খেয়েছি। এখান থেকে আমি ২০টি চারা ক্রয় করেছি। এগুলো আমাদের বাগানে রোপণ করতে ফরিদগঞ্জ নিয়ে যাব।
শফিক নামে আরেক দর্শনার্থী বলেন, এখানে বিদেশি জাতের আঙুরের বাগান করা হয়েছে। আমি ফলগুলো খেয়েছি, অনেক মিষ্টি। আমার ইচ্ছা, ভবিষ্যতে একটি ছাদ বাগান করব।
স্থানীয় বাসিন্দা সজীব বলেন, আমি মাঝেমধ্যে আঙুরের বাগান দেখতে আসি। বাগানটা দেখতে অনেক সুন্দর, মনটা ভালো হয়ে যায়। আমারও ইচ্ছা আছে এখান থেকে চারা নিয়ে একটি আঙুর বাগান তৈরি করার।
এ বিষয়ে কৃষি উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান প্রধানিয়া বলেন, আমাদের এই প্রজেক্টের বয়স মাত্র ১০ মাস। এই প্রজেক্ট আমরা গত বছরের জুনে চালু করি। বাছাইকৃত জাত নিয়ে এই প্রজেক্ট। এখানে আটটা বাণিজ্যিক জাতের ১২০টি আঙুর গাছ আছে। এসব গাছে প্রচুর ফলন আসছে। এ ছাড়া আমাদের কাছে শতাধিক জাত সংরক্ষিত আছে। এগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তা এখনো বাজারে ছাড়ানো হয় নাই। আপাতত আমরা ২০-২৫টি জাত সম্প্রসারণ নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে আটটি সুপার বাণিজ্যিক জাত। এগুলো বাজারজাত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি আঙুর ফলের পাশাপাশি চারা বিক্রয় করি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে চারা ক্রয় করেন। অনলাইনেও চারা বিক্রয় করা হয়। গড়ে প্রতিদিন শতাধিক চারা বিক্রয় হয়। যারা নতুন বাগান করতে চায়। তারা নতুন জাতের পেছনে না ঘুরে দেশে যেসব আঙুরের জাত সফল সেই সব জাত নিয়ে কাজ করেন।
তিনি আরও বলেন, আমি ২০১৯ সাল থেকে আঙুর নিয়ে কাজ করছি। আমরা ২০২২-২৩ সালে বেশির ভাগ বিদেশি জাতের আঙুর সংগ্রহ করেছি। ২০২৪ সালে ছাদ বাগানে ভালো ফলন হয়। তারই প্রেক্ষিতে একই সালের জুনে আমরা এই প্রজেক্টটি শুরু করি। এখানে ছাদ বাগানের থেকে বেশি ফলন হয়েছে। আমরা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাত সংগ্রহ করি। বিদেশি জাতগুলো ইউরোপ থেকে সংগ্রহ করি। তারপর এগুলো চাষাবাদ করি, ফলনও ভালো হয়। আমরা প্রায় শতাধিক জাতের আঙুর নিয়ে কাজ করি। আমার জানামতে চাঁদপুরে এখনো কেউ আঙুর চাষ করে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু তাহের বলেন, বাংলাদেশে আঙুর চাষ নিয়ে গবেষণার জন্য কৃষি বিভাগ চেষ্টা করছে। চাঁদপুর সদর উপজেলা কৃষি উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান নামে এক যুবক একটা বাগানে অনেকগুলো জাতের আঙুর চাষ করেছেন। ইতোমধ্যে তার প্রায় আটটা জাতের আঙুরের ফলন এসেছে। তার আঙুরগুলোর ফলন খুবই ভালো এসেছে। আমরা পর্যবেক্ষণ করতেছি। আমাদের দেশের আবহাওয়া যদি আঙুর চাষের অনুকূলে হয় তাহলে সারা বাংলাদেশে এই ফল চাষ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, আঙুর যেসব জায়গায় চাষ করা যায়। সেখানে শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজিও চাষ করা যায়। এটি একটি অর্থকরী ফসল এবং লাভজনক। এখন আঙুরের দাম প্রায় ৪০০ টাকা কেজি। মতলব উত্তর উপজেলায় নাসির উদ্দিন সরকার নামে এক ব্যক্তি এক বিঘা জমিতে আঙুর চাষ করেছেন। সেটিতে এখনো ফলন আসে নাই। এটিতে যদি ফল আসে। দুটি তুলনা করে যদি বুঝি, আঙুর চাষ দেশের আবহাওয়া, মাটি ও তাপমাত্রা সঙ্গে খাপ খাবে। তাহলে চাঁদপুরসহ সারা দেশে আঙুর চাষ ছড়িয়ে দেব।