পানির অভাবে জমি ফেটে চৌচির

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥

ডাকাতিয়া নদীর চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের আওতায় জেলার ৫টি ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার দুইটি ওয়ার্ডের কৃষকেরা পানির অভাবে বোরো চাষের আবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তবে দ্রুত জমিগুলো সেচের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদপুর সদরে চান্দ্রা ও লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন, ফরিদগঞ্জ পৌর ৪ ও ৫নং ওয়ার্ডের ৩টি স্কীম, উপজেলার ১৫নং রুপসা উত্তর ও ১৬নং রুপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন, গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের পানির সংকটে বোরো চাষ ব্যাহত হচ্ছে।

গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের আদশা, খাজুরিয়া, মান্দারতলী, হুগলি, সাইসাঙ্গা এলাকার কৃষকদের অভিযোগ চাঁদপুর সেচ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে খালে পানি সরবরাহ না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

সরেজমিনে গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, একরের পর একর জমির কৃষকরা ধানের চারা লাগানোর জন্য প্রস্তুত করে রাখলেও পানির অভাবে আবাদ করতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে দুই-একটি জমিতে ধানের চারা রোপণের দৃশ্য দেখা গেলেও সেগুলোও পানি শূন্য। এছাড়া খালগুলোতেও পানি দেখা যাচ্ছে না।

স্থানীয়রা জানায়, প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে খালে পর্যাপ্ত পানি চলে আসায় তারা সেচের মাধ্যমে ইরি-বোরো মৌসুমে চাষাবাদ করতেন। কিন্তু এ বছর জানুয়ারি মাস পার হয়ে গেলেও পানির খবর নেই।

এ বিষয়ে কৃষকরা জানিয়েছেন, পানি অভাবে আমাদের ক্ষতি হয়েছে। জমি শুকায়ে আছে। খরচ বেড়ে গেছে। পানি সময়মতো এলে আমরা সময়মতো গৃহস্থ করতে পারতাম। এছাড়াও অনেকে খালের পুরোনো পানি দিয়ে আগাম সেচ দিয়ে ধান চাষ শুরু করে বিপাকে পড়েছেন। তাই পুকুরের পানি দিয়ে চাষ করছেন।

মান্দারতলী গ্রামের আবুল হাশেম জানান, একুট আগে ধানের ফসল পাওয়ার আশায় খেতে খালের পুরান পানি দিয়েছি। খালে নতুন পানি আসলে কীটনাশক ব্যবহার করলে ধান গাছ মোট তাজা হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে পানি না আসায় ধানের চারা লাল হয়ে মরে যাচ্ছে। আমাদের অতি দ্রুত স্কীমের পানি প্রয়োজন।

আরেক কৃষক তাজুল ইসলাম জানান, নির্ধারিত সময়ে পানি আসবে ভেবে জমি নির্বাচন করি। কিন্তু পানি না আসায় ধানের চারা (জালা) বড় হয়ে গেছে। তাই চারাগুলো গরুকে খাওয়াচ্ছি। জমি হালের ট্রাক্টর খরচ দিতে হবে ।

কৃষক জাকির হোসেন জানান, গত ৩০-৪০ বছর ধরে খাল সংস্কার করা হচ্ছে না। এই এলাকা কিছুটা উঁচু হওয়ার কারণে পানি সঞ্চালনায় সমস্যা হয়। তাই খাল খনন করাও জরুরি। যাতে আমরা সারাবছর নিরবচ্ছিন্ন পানি পেতে পারি। আগামী ১০-১৫ দিনের মাধ্যে যদি ভেকু দিয়ে খাল খনন করে দেয়, তাহলে আমাদের উপকার হবে।

তিনি আরও বলেন, ধানের দামের চেয়ে প্রয়োজনীয় কীটনাশকের দাম অনেক বেশি। পুকুর মাছ বিক্রয় করে পানি ছেকে ধান গাছের কাজে লাগাচ্ছি । এতে খরচ বেড়ে যায়। এ বছরতো বিপদেই রয়েছি।

আদশা গ্রামের সেচ ম্যানেজার আব্দুল কাদের জানান, প্রতি মৌসুমের জানুায়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে কৃষকদের ধান চাষ শেষ হয়ে যায়। আমি সেচ মেশিন নিয়ে প্রস্তুত থাকলেও খালে পানি না থাকায় কিছুই করতে পারছি না। সেচের পানির জন্যে ধান খেতের পাশ দিয়ে যাওয়া সেচের ড্রেনগুলো সংস্কার করে প্রস্তুত করলেও কোনো লাভ হয়নি। এতে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। খাল সংস্কার করা হয়েছে আজ থেকে ২৪-২৫ বছর আগে। এতে খাল বিভিন্ন কারণে উঁচু হয়ে যায়। যার কারণে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় পানি খালে আসে না।

আদশা গ্রামের সাবেক সেচ ম্যানেজার ও কৃষক আবুল কালাম জানান, আমি এ স্কীমের ১৯৭৯ সালের ম্যানেজার ছিলাম। ১৯৮১ সালের পর থেক খালটি সংস্কার করা হয়নি। প্রতি বছর জানুয়ারি প্রথম দিকে ধান রোপণ করে থাকি। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত কোনো পানি আসেনি। মৌসুমে প্রথমে ড্রেনগুলো সংস্কার করে প্রস্তুত করা হয়। জামিতে হাল, বীজ, ড্রেন সংস্কার করার কারণে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। পানি আসবে ভেবে অনেকে কিছু জমিতে পুকুর থেকে পানি তুলে ধানের চারা রোপণ করেন। কিন্তু এখনো পানি আসেনি। যদি পানি না আসে তাহলে কৃষকদের ভিক্ষা করতে হবে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদ বলেন, প্রতি বছর জানুয়ারির শুরুতে পানি আসলেও এ বছর তার ব্যতিক্রম। এখন পর্যন্ত খালে পানি আসেনি। পানির অভাবে কৃষকদের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। পানি না আসার কারণে বোরো মৌসুমে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। তারা আমাকে অবহিত করেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবহিত করি। তারা পরিদর্শন করেন। উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নের তুলনায় ইউনিয়নের খালগুলো একটু উঁচু থাকার কারণে পানি প্রবাহিত হচ্ছে না এটি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আজ বিকেলে উপজেলায় কমিটির আলোচনা সভা হবে। আমার ইউনিয়নে ৫৭০ সেক্টর জমিতে ধানের আবাদে সেচের পানি না থাকায় সমস্যা হচ্ছে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: কামরুজ্জামান বলেন, নদীতে পানি কম থাকায়। চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের আওতায় সেচ পাম্পে পানির লেভেল না থাকায় পানি আসতে দেরি হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক হলে পানি আসবে। পৌরসভার দুটি ওয়ার্ড, উপজেলার ৬নং গুপ্টি ইউনিয়ন, রুপসা ১৫নং রুপসা উত্তর ইউনিয়ন, ১৬ নং রুপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের পানি যেতে সমস্যা হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এসব বিষয়ে উপজেলায় কমিটির আলোচনা সভা করা হয়েছে।

চাঁদপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আয়শা আক্তার জানান, চাঁদপুর উপজেলার দুটি ইউনিয়নে ২৫০ হেক্টর জমিতে সেচের পানির স্বল্পতার কারণে বোরো আবাদ বিঘ্নিত হচ্ছিল। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। তারা এর কার্যক্রম শুরু করেছে। এখন সিআইপি বাধের মধ্যে পানি বৃদ্ধি করা হয়েছে। সকলের সমন্বয়ে খালের যে সকল জায়গায় বালু ,বর্জ্য জমে আছে সেগুলো পরিষ্কার করা হবে। দুই-একদিনের মধ্যে সমস্যা সমাধান হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী বলেন, চাঁদপুর সদর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে সেচের সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। ইতোপূর্বে জেলা প্রশাসন,পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নিয়ে খালগুলোতে পরিদর্শন করেছে। সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কাজ চলছে। আমরা আশা করি দ্রুত সমাধান হবে।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম রেফাত জামিল জানান, ডাকাতিয়া নদী থেকে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের সেচ পাম্পের ছয়টির মধ্যে চারটি পাম্প পানি সরবরাহ করে যাচ্ছে। এ বছর পানির লেভেল ২.৮ লেভেলে রেখেছি। যা অন্যান্য বছরের তুলনায় পানির লেভেল ৫ সেন্টিমিটার ওপরে ।
তিনি আরও বলেন, চাঁদপুর সদর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলায় কিছু অংশে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা ইতোপূর্বে খালগুলো পরিদর্শন করেছি। বিভিন্ন কারণে খালগুলো অনেক অংশ ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে না। স্থানীয়ভাবে সমন্বয় করে নেওয়া হয়েছে। খালগুলো খনন করার স্ব-স্ব উদ্যোগে নেওয়া হচ্ছে। পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করার জন্য আমরা কাজ করছি। আশা করি দ্রুত কৃষকদের খালগুলোতে পানি যাবে।

Loading

শেয়ার করুন: