আমিতো স্টোক করছি, কই আমনে

মির্জা জাকির ॥

চাঁদপুর আড়াইশ শষ্যার হাসপাতালের চতুর্থ তলার মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন হাজেরা বেগম।এক সপ্তাহ আগে ভর্তি হয়েছেন এখানে। হাসপাতালের খাতায় বযস ১০১বছর।সুন্দর ফর্সা, মুখমন্ডল গোলাকার। কথা বলেন স্পষ্ট করে। বার্ধক্যজনিত রোগের পাশাপাশি এখন হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। নতুন করে শরীরের নিচের একসাইডে কিছুটা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। আপনজন বলতে কেউ নেই এই শতায়ু নারীর। যারা তাকে চিনেন তাদের কেউ কেউ খবর পেয়ে তাকে দেখতে ছুটে আসেন হাসপাতালে।

এক সপ্তাহ আগে হাসপাতালে ভর্তি হলেন।যেদিন ভর্তি হবেন সেদিন সকালে আমাকে ফোন দিলেন।”আপনি কই,আমিতো স্টোক করছি।আমি হাসপাতালে যাইতাছি,আপনি রুবেল স্যারেরে কইয়া দিয়েন”।তারপর হাসপাতালে ভর্তি হলেন। সেখানে এই বৃদ্ধার পরিচিত কেউ তাকে ভর্তি হতে সহায়তা করেছেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমাকে আবার ফোন দিলেন। বললেন, আপনি যে আমারে দেখতে আইয়েন না। আমার খবর যে নেন না।রুবেল স্যারেরে কন আমারে চাইয়া যাইতো।আমি ডাক্তরের খরচ দিমু”। সেদিনই শুক্রবার বিকেলে হাসপাতালে গেলাম এই বৃদ্ধাকে দেখতে। কথা বললাম কর্তব্যরত নার্সদের সাথে। পাশের বেডের রোগিরা জানান , বুড়ি সারা রাত ঘুমায়নি।শুধু কথা বলেন, আমরা ঘুমাতে পারিনা তার জন্য।দেখলাম স্যালাইন চলছে। দু’জন নারী তাকে দেখাশোনা করছেন। আমি হাসপাতাল থেকেই এই বৃদ্ধার চিকিৎসক সিনিয়র কনসালটেন্ট ডক্টর সালেহ আহমেদ ভাইকে ফোন দিলাম। জানতে পারলাম বার্ধক্যের পাশাপাশি ডায়াবেটিক,আর্থাইটিসসহ নানা সমস্যার কথা। এই শতায়ু বৃদ্ধার স্বজন বা আপনজন কেউ না থাকার বিষয়টি জানলাম।

হাজেরা নামে এই বৃদ্ধার সাথে আমার পরিচয় তিনবছর আগে শহরের বিপনীবাগ বাজারের পাশে নিলয় স্টোরে। একদিন সন্ধ্যায় ওই দোকানের মালিক বৃদ্ধাকে দেখিয়ে বললেন তাকে একটু সহযোগিতা করতে।অনেক টাকার ঔষধ লাগে। জানলাম তার অসহায়ত্বের কথা। তার স্বামী সন্তান কেউ বেঁচে নেই।চল্লিশ বছর পূর্বে রাজশাহী থেকে একা চাঁদপুর আসেন।ভিক্ষা না করে পুলিশের রান্নাঘরে অন্য নারীদের সাথে কাজ করতেন।পরে বয়সের ভারে আর কাজ করতে পারেন না বলে শহরের নির্দিষ্ট দুইটি স্থানে (দিনে হাকিম প্লাজায় ডাচ বাংলা ব্যাংকের নীচে ও বিকেলে সাউথ প্লাজায়) বসতেন।পরিচিতজনরা সহযোগিতা করতেন।সন্ধ্যায় বাসায ফিরে যাবার পূর্বে আল আরাফ হোটেল থেকে রুটি ভাজি নিয়ে আসতেন।

নিজে রান্না করে খেতেন না।হোটল থেকে বা পরিচিত কেউ খাবার কিনে দিতেন বলে জানান। শহরের জিয়া হোস্টেলের পাশে মোল্লা বাড়ির নুরুর একটি ছোট্ট ঘরে একা থাকেন তিনি।নুরু মোল্লা বিপনিবাগ বাজারের ব্যবসায়ী।বিনা ভাড়ায় নুরু মোল্লা এই বৃদ্ধাকে থাকতে দিয়েছেন। এভাবেই কেটে যাচ্ছে এই বৃদ্ধার জীবন।

বৃদ্বা হাজেরা আমাকে জানান ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ পেলে তার অনেক উপকার হয়।আমি তাকে পরদিন হাসপাতালে যেতে সময দিয়ে দিলাম। আমার মোবাইল নাম্বার রাখলেন।পরদিন আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার(আরএমও) ডা সুজাউদ্দৌলা রুবেলকে এই বৃদ্ধার অসহায়ত্বের কথা জানালাম। তিনি তাকে দেখে এক মাসের ঔষধ লিখে হাসপাতাল থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।এভাবে গত তিন বছর ধরে এই বৃদ্ধা সদর হাসপাতাল থেকে সহযোগিতা পেয়ে আসছেন।সবার কাছে” রুবেল স্যার আমারে ওষুধ ও চিকিৎসা দিছেন,আল্লাহ তারে বড় করুক দোয়া করি”এসব বলতেন।

বর্তমানে হাসপাতালের বেডে শুয়েও ডা. রুবেল সাহেব কেন তাকে দেখতে আসেন না আমার কাছে জানতে চান।আমি তাকে আশ্বস্ত করেছি ডা. রুবেল সাহেব তাকে দেখতে আসবেন।

আমি প্রায় প্রতিদিনই দেখতে হাসপাতালে যাই। এই বৃদ্ধার পরিচিত যারা আছেন তারা সবাই হাসপাতালে এসে তাকে দেখে যান।আক্তার নামে একজন পুলিশ সদস্যও তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. মাহবুবুর রহমানকে বৃদ্ধা হাজেরার বিষযটি জানানোর পর তিনি তার খোঁজ খবর নেন।

বর্তমানে বৃদ্ধা হাজেরা হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগের সহযোগিতায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইতোপূর্বে গেল বছরে তিনি বিনামূল্যে চাঁদপুর মাজহারুল হক চক্ষু হাসপাতালে চোখের চিকিৎসা নেন।যে কারণে তিনি পরিচিত সবাইকে ভালো করে চিনেন, কথা বলেন।তিনি চাঁদপুর পৌরসভা থেকে বযস্ক ভাতাও পাচ্ছেন। তার উপার্জিত কিছু টাকা এই শহরের কয়জনের কাছে জমা আছে বলে তার কাছে জানাযায়। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ জেলা প্রশাসন এগিয়ে আসলে, সহানুভূতি দেখালে হয়তো দ্রুত সুস্থ হয়ে উৃঠতে পারেন এ শতায়ু বৃদ্ধা হজেরা। পরিশেষে সুস্থ হযে ফিরে আসুন সকলের মাঝে- চিরচেনা পরিবেশে এ দোয়া করি।

Loading

শেয়ার করুন: