নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ। এটি মোঘল সাম্রাজ্যের সুলতান, বৃটিশ শাসক, রাজা বা বাদশা নির্মাণ করেননি। মসজিদটি সরাসরি ইট, বালু, রড, পাথর দিয়েও তৈরি হয়নি। বাংলা ১৩২৫ থেকে ১৩৩০ বঙ্গাব্দের মধ্যে হাজী আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। প্রথমে একচালা খড়ের ইবাদতখানা, পরে খড় ও গোলপাতা দিয়ে তৈরি দোচালা মসজিদ নির্মাণ করেন।
১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৭ আশ্বিন পাকা করা হয়। চাঁদপুর জেলা শহরের ২০ কিলোমিটার পূর্বে কুমিল্লা-চাঁদপুর মহাসড়কের পাশে হাজীগঞ্জ বাজারে মসজিদটি অবস্থিত।
মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১১৭৫ থেকে ১২০০ বঙ্গাব্দের মধ্যে হযরত মকিমউদ্দিন (রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে আরব থেকে হাজীগঞ্জে আগমন করেন। তিনি সপরিবারে বর্তমান বড় মসজিদের মেহরাব সংলগ্ন স্থান, যেখানে একটু উঁচু ভূমি বিদ্যমান ছিল সেখানে আস্তানা তৈরি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তারই বংশের পুরুষ হযরত মনিরুদ্দীন হাজী ওরফে মনাই হাজীর (রহ.) দৌহিত্র হাজী আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) ১৩২৫ থেকে ১৩৩০ বঙ্গাব্দের দিকে বড় মসজিদের মেহরাব বা তৎসংলগ্ন স্থান জুড়ে প্রথমে একচালা খড়ের ইবাদতখানা, পরে খড় ও গোলপাতা দিয়ে তৈরি দোচালা মসজিদ নির্মাণ করেন। যা পরবর্তী সময়ে পাকা মসজিদ করা হয়।
১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৭ আশ্বিন আহমাদ আলী পাটওয়ারীর (রহ.) ইচ্ছায় মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.) পাকা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। মসজিদের ছাদ তৈরির জন্য তিনি কলকাতা গিয়ে জাহাজ ভাড়া করে লোহার ভিম ও ফ্লোরের জন্য মর্মর পাথর আনেন। প্রথম পর্যায়ে ২০০০ বর্গহাত আয়তনের বিশাল মসজিদের মেঝেতে মর্মর পাথর বসানো হয়। সাত বছর সময়ের মধ্যে মূল মসজিদ দালান সম্পন্ন করা হয়। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ১০ অগ্রহায়ণ নবনির্মিত মসজিদ উদ্বোধন করা হয়।
ঐতিহাসিক এই মসজিদটি তিন ভাগে নির্মিত হয়। মেহরাবসহ মসজিদের প্রথম অংশটি ৪ হাজার ৭৮৪ বর্গফুট। মাঝের অংশটি ১৩ হাজার ৬ বর্গফুট। আর বারান্দা বা সুউচ্চ মিনারসহ তৃতীয় অংশটি ১ হাজার ৬১৫ বর্গফুটসহ মসজিদটির সর্বমোট আয়তন ২৮ হাজার ৪০৫ বর্গফুট। ১৯৫৩ সালে মসজিদের পূর্ব সীমানার প্রধান দরজায় ১২২ ফুট উঁচু মিনার তৈরির কাজ শুরু হয় এবং তার পাশে গম্বুজ প্রস্তুত করার করা হয়। এই কাজ ১৯৫৭ সালে শেষ হয়। আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) ৩২ বছরে বিশাল মসজিদের মেহরাব থেকে মিনারা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ করেন। আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) মত্যুর আগে তার তৃতীয় পুত্র মো. মনিরুজ্জামান পাটওয়ারীকে মোতাওয়াল্লি পদে দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্বভার অর্পণ করেন। তিনি বাবার পরামর্শ মোতাবেক মসজিদের তৃতীয় অংশে দোতলা নির্মাণের অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। তার দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক বছর পর আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) মৃত্যুবরণ করেন।
স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে হাজী আহমাদ আলী পাটোয়ারীর (রহ.) ওয়াকফকৃত সম্পত্তিতে গড়ে ওঠেছে হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ কমপ্লেক্স। প্রতিষ্ঠাতা মোতাওয়াল্লি হাজী আহমাদ আলী পাটওয়ারীর মৃত্যুর পর থেকে তার বংশধররাই এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার মৃত্যুর পর দায়িত্ব পালন করেন তার তৃতীয় ছেলে মো. মনিরুজ্জামান পাটওয়ারী এবং তার মৃত্যুর পর মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব নেন বড় ছেলে হাজী মো. আলমগীর কবির পাটওয়ারী। বর্তমানে ড. মো. আলমগীর কবির পাটওয়ারীর ছেলে মোতাওয়াল্লির দায়িত্বে আছেন। তবে মসজিদ পরিচালনায় সভাপতি- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, আছেন ৯ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, দোতলা বিশিষ্ট প্রায় ১০৫ বছরের পুরোনো বিশাল এক মসজিদ। মেহরাবটি কাচের ঝাড়ের টুকরো নিখুঁতভাবে কেটে কেটে মনোরম ফুলের ঝাড়ের মতো আকর্ষণীয় নকশায় সাজিয়ে তোলা। মাঝের অংশটি আকর্ষণীয় পিলার ও ঝিনুকের মোজাইক দিয়ে নির্মিত। সুউচ্চ মিনারের চূড়ায় ওঠাতে মিনারের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে সিঁড়ি। এর ভেতরে কারুকাজ করা।
দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটির নির্মাণশৈলী এক নজর দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন হাজারো পর্যটক। মিনারের উঁচু প্ল্যাটফর্মে বহু মুসল্লি ও পর্যটক উঠে হাজীগঞ্জের চারপাশের দৃশ্য অবলোকন করেন। অনেকে নামাজ আদায়ের পর মুঠোফোনে সেলফি তুলেন। নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা নামাজের জায়গা। এই মসজিদে রোগবালাই থেকে মুক্তি লাভের আশায় ও বিভিন্ন কারণে মানত করতেও আসেন অনেকে। মসজিদের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার মিলে প্রায় ২০ হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। এখানে একসঙ্গে প্রায় সময়ে প্রতি শুক্রবার ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে আসেন। তবে পবিত্র রমজান মাসে প্রতি শুক্রবার ৩৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। বিশেষ করে প্রতিবছর জুমাতুল বিদার নামাজ পড়তে এ মসজিদে লাখো নারী-পুরুষের সমাগম ঘটে। এই সময়ে নিচতলা থেকে দ্বিতীয় তলা, মসজিদ মাঠ প্রাঙ্গণ এবং চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের মুসল্লিদের নামাজ আদায় করতে দেখা যায়।
হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম পাটওয়ারী বলেন, হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। এটি একটি পুরোনো মসজিদ। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ প্রতিদিন এখানে নামাজ পড়তে আসে। জুমার দিন লোকজন বেশি হয়।
শরীফ মজুমদার নামে এক যুবক বলেন, এই মসজিদে লাখো মানুষ নামাজ পড়তে আছেন। প্রতি ওয়াক্তে ৫-৬ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। ধর্মীয় দিবস শবে বরাত-মেরাজে লক্ষাধিক মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে জুমাতুল বিদায় লক্ষাধিক মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন।
সিয়াম নামে স্থানীয় আরেক যুবক বলেন, হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদ। আমি এ উপজেলার বাসিন্দা হিসেবে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি। মসজিদে আসলে খুবই ভালো লাগে। প্রতিদিন এখানে নামাজ পড়ি। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে আসেন। এতো সুন্দর দৃষ্টিনন্দন মসজিদ পেয়ে আমরা আন্দনিত।
মতলব উত্তর থেকে আসা মমিন সরদার বলেন, হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য এখানে এসেছি। মসজিদের ভেতর ও বাহির অপরুপ সুন্দর। এখানে নামাজ পড়লে আল্লাহ কবুল করবেন- সেই প্রত্যাশা নিয়ে এসেছি।
ফেনী থেকে আসা শাহ আলম বলেন, আমি ফেনী থেকে প্রায় সময়ই এখানে নামাজ পড়তে আছি। এখানে নামাজ পড়তে আসলে অনেক ভালো লাগে। মনটা ভালো থাকে।
স্থানীয় সাংবাদিক এনায়েত মজুমদার বলেন, আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগে বিটিভিতে মাগরিবের আজানে হাজীগঞ্জ বড় মসজিদের মিনারের ছবি দেখাতো। এই মসজিদটি এশিয়া মহাদেশের অন্যত ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদ। এ মসজিদকে কেন্দ্র করে আজকে হাজীগঞ্জ একটি বিশাল বাণিজ্যিক বাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। হাজী আহমাদ আলী পাটোয়ারীর ওয়াকফ এস্টেট মসজিদ যদি তৈরি না করতেন, তাহলে ৭ হাজার ব্যবসায়ীর কর্মসংস্থান হতো না। এই বাজারে ছোট-বড় ১০ হাজার ব্যবসায়ী আছেন। মসজিদকে কেন্দ্র করে এখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
হাজীগঞ্জ বড় মসজিদের প্রধান মুয়াজ্জিন হাফেজ মাওলানা শাহ এমরান বলেন, আমি ২৫ বছর ধরে এ মসজিদে খেদমত করছি। প্রতি রমজান মাসের ২০ তারিখ থেকে এতেকাফে লোকজন আসে। এতে বিশাল এক আয়োজন হয়। প্রতিটি জুমার নামাজের দিন মুসল্লিদের উপস্থিতির কারণে মসজিদের আশপাশের রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
হাজীগঞ্জ বড় মসজিদের খতিব মুফতি আব্দুর রউফ বলেন, অনেক দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিরা জামাতে শরিক হন। হাদীসে আছে বড় জামাতে শরিক হওয়ার একটা ফজিলত ও সওয়াব আছে। এজন্য বিশেষ করে রমজান মাসে বিশাল জামাত হয়। অন্যান্য সময়ে ১৫-২০ হাজার মুসল্লি জামাতে অংশগ্রহণ করেন। তারাবিহতে কয়েক হাজার মুসল্লি হয়।
হাজীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আ.স.ম মাহবুব-উল আলম লিপন বলেন, হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ চাঁদপুর জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। উপজেলাবাসী এর সাক্ষী। এই মসজিদে দেশের নাম করা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নামাজ পড়েছেন। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ দেশ বরেণ্য নেতৃবৃন্দ এ মসজিদে নামাজ পড়েছেন। তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মসজিদটি মানুষদের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মসজিদের সভাপতি তাপস শীল বলেন, উপজেলার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো- হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
মসজিদের সাবেক মোতওয়াল্লি ড.মো.আলমগীর কবির পাটওয়ারী বলেন, হাজীগঞ্জ ঐতিহ্যবাহী বড় মসজিদ একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান। মসজিদ প্রাঙ্গনের গ্রামের নাম মকিমাবাদ। হাজী মকিমউদ্দিন (রহ.) নামে গ্রামটির নাম করণ করা হয়েছিল। হাজী মকিমউদ্দিন (রহ.) উত্তরসুরি হাজী মনিরুউদ্দিন (রহ:)’র এ এলাকায় একটি দোকান ছিল। দোকানটি হাজী’র দোকান নামে ওই সময়ে ব্যাপক পরিচিত লাভ করে। তার হাজী দোকান নামের থেকে হাজীগঞ্জ নাম করণ করা হয়। তার দৌহিত্র আহমাদ আলী পাটওয়ায়ী মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদ প্রতিষ্ঠা কালীন সময়ে থেকে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের নাম এখানে রচিত আছে।
বর্তমান মোতওয়াল্লি প্রিন্স শাকিল আহমেদ বলেন,আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগে আহমাদ আলী পাটওয়ারী আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার উদ্দোশ্যে নিজের ব্যক্তি সম্পত্তি দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করে ওয়াক্ফ করে গেছেন। তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মসজিদটি নির্মাণ করেতে তিনি সরকার কিংবা কোন রাজা ,বাদশাহদের কাছে এক টাকাও নেননি। তার বক্তিগত টাকা দিয়েই মসজিদটি নির্মাণ হয়েছে। তার মৃত্যুর পর পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আমার বাবা ড.মো.আলমগীর কবির পাটওয়ারী মোতওয়াল্লি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দায়িত্ব পালনের আগে মসজিদটি অবস্থা বেহাল ছিল। তখন মাত্র ৬জন কর্মচারী ছিল। মসজিদ চালানো তার জন্য কষ্টকর ছিল। পরে তিনি মসজিদের জন্য আরও কিছু সম্পত্তি ক্রয় করেন। সেই সম্পত্তির মধ্যে মার্কেট তৈরী করেন। মার্কেট তৈরী করতে লোন নিতে হয়েছে। প্রতিমাসে এ লোন পরিশোধ করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, এখন শতাধিক কর্মকর্তা -কর্মচারী আছে। আমরা চেষ্টা করি মুসল্লিদের সেবা মান ভাল করতে। মুসল্লিদের সেবা করা চিন্তা করে মসজিদের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চেস্টা করি। মসজিদের উন্নয়ন করতে গিয়ে আমরা কোন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা , কিংবা ব্যক্তির কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেই নি। তবে মুসল্লিরা যেই দান/অনুদান প্রদান করে তা আর মার্কেটের ভাড়ার টাকা দিয়ে মসজিদের উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা হয়। নিজের রক্তের বিনিময় হলে মসজিদের উন্নয়ন ধরে রাখব। কারণ এটি আমাদের পূর্বপুরুষ প্রতিষ্ঠিত মসজিদ।